বাসুদেব ভট্টাচার্যী খোয়াই ১৬ই জুন…….কথায় বলে খোয়াই হল সংস্কৃতির শহর ,নাটকের শহর। খোয়াই নামটির সঙ্গে সংস্কৃতি এবং নাটক দুটি শব্দ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। ছোট থেকেই থেকেই খোয়াই এর পুরনো টাউন হলে বারবার ছুটে যেতাম নাটক দেখার আশায়। বহুদিন পর আবার খোয়াই পুরনো টাউন হল ভরে উঠলো নাটকের বলিষ্ঠ সংলাপে। নাট্যোৎসবের শেষ লগ্নে ফিরে আসার সময় দেখছিলাম সম্পাদক সৌরজিৎ গোপ এর চোখে জল এ যেন পরম প্রাপ্তি ও পরম তৃপ্তির। আসলে এই নাট্য উৎসব খোয়াই এর সমস্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সমস্ত সাংস্কৃতিক সংস্থা কে এক মঞ্চে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তারা। তিন দিনে প্রায় শতাধিক কুশীলবরা দাপাদাপি করে বেড়িয়েছে এই মঞ্চ জুড়ে। সুরে ছন্দে তালে নাটকের গন্ধে হলঘর ছিল মুখরিত। সবার মুখে একটিই কথা ‘আবার আসুক নাটকের জোয়ার’ নাটক হল সমাজের দর্পণ। সমাজে যে সমস্ত মারাত্মক সমস্যা গুলো প্রতিনিয়ত আমাদেরকে এবং আমাদের নবীন প্রজন্ম কে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে তাদেরকে আবার সুপথে ফিরিয়ে আনার এক বলিষ্ঠ মাধ্যম হল নাটক। সাধারণত মুখের কথায় বা বই পড়ে যে জিনিসটা উপলব্ধি করা যায় না সেটা ছোট্ট একটি নাটকের মধ্য দিয়ে এই তিন দিনে এমন অনেক কথাই আমাদের মনে গেঁথে দিয়ে গেছে নাটকের কুশীলবেরা। দর্শকের দৃষ্টিতে মনে করি এই নাট্য উৎসব খোয়াই এর দর্শকদের মধ্যে যেমন নাট্য মনস্কতা ফিরিয়ে দিয়েছে তেমনি নাট্য নির্মাতাগন কেও নুতন করে ভাববার সুযোগ করে দিয়েছে। দেখাগেছে অনুষ্ঠানের অতিথি বর্গকে চিরাচরিত প্রথায় ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে যা বহু আগে থেকেই চলে আসছিল। কিন্তু এখানে সবচাইতে ভালো লেগেছে, এই প্রথম দেখলাম কোন অনুষ্ঠানে দর্শকদের কেও ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে সংস্থার কচি কাঁচা দের দিয়ে। এর মধ্যে দিয়ে নাট্য সংসদ একটি মেসেজ দিতে চেয়েছে যে ,এসো এই সন্ধ্যের সময়টা টিভি কিংবা মোবাইলের সামনে না বসে শিশুদের সৃজনশীল কর্মকাণ্ড গুলি দেখে নিজেদের কে সমৃদ্ধ করি অথবা সমাজকেও সমৃদ্ধির দোর গোড়ায় নিয়ে দাঁড় করাই। এই অভিনব ভাবনার জন্য নাট্য উৎসব পরিচালন কমিটি ও কনভেনার সৌরভ দাস এর কৃতিত্ব অনস্বীকার্য বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরেকটা বিষয় অবাক লেগেছে, প্রতিদিনই রাত এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত খোয়াই এর মঞ্চে নাটক চলেছে। এরকমটা ত্রিপুরা রাজ্যের আর কোথাও সম্ভব কিনা খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। আমরা ছোটবেলা এমন যাত্রা দেখেছি সারারাত ধরে মেঝেতে বসে। কিন্তু প্রতিদিন তিনটি চারটি করে নাটক থাকায় নাটক শেষ হতে হতে প্রায় এগারোটা কিংবা সাড়ে এগারোটা বেজেছে। কিন্তু তখনও কিন্তু দর্শকের হাততালি বারবার হল ঘরে অনুরনিত হয়েছিল।
আমার পাশে দর্শক আসনে যারা ছিলেন তাদের অনেকেরই মুখে শুনেছি নতুন আশার বাণী ।বলে গেছেন ছেলেমেয়েদের নাটকের নেশা চেপে গেলে সুস্থ সংস্কৃতির মেলবন্ধন থেকে তারা কখনো হারিয়ে যাবে না। সর্বোপরি নাট্যকার – কুশীলবরা এক সুন্দর মন নিয়ে সমাজের যেখানে অন্যায় অত্যাচার অবিচার দেখবে সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।খোয়াই শহরের নাম সারা ত্রিপুরায় নয় সারা ভারত জুড়ে এমনকি বাংলাদেশও রয়েছে। এর একমাত্র কারণ নাট্যচর্চা কিংবা সংস্কৃতি চর্চা। এক্ষেত্রে হীরেন্দ্র সিনহা স্যার অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। উনারই স্মৃতি বিজড়িত এই নাট্য উৎসব আশা করি এখন আবার নাট্য প্লাবনে আমাদেরকে সমৃদ্ধ করে রাখবে ।
এবার আসি তিন দিনের নাটকের কথায় –
প্রথম দিনের প্রথম নাটকে হাজির ছিল খোয়াই এর বিশিষ্ট নাট্য সংস্থা কালচারাল ক্যাম্পেইন তাদের দুটি অনু নাটক নিয়ে। প্রথম নাটক – ‘হাসির কুটুম’। যেখানে হাসির মতো ফুটফুটে মেয়েকে অপহরণ করতে এসে অপহরণ কারী নিজেই মনুষ্যত্বের বেড়াজালে আটকা পড়ে যায়। ছোট্ট নাটক কিন্তু দারুন মেসেজ দিয়ে যায় সমাজের কাছে। বিশেষ করে হাসি, হাসির মামা, দিব্য দারুন অভিনয় করেছে।
প্রথম দিনের দ্বিতীয় নাটক ‘অদ্ভুত অসুখ’। এটি ছিল কালচারের ক্যাম্পেইনের দ্বিতীয় প্রযোজনা।এই অসুখে আমি আপনি অর্থাৎ আট থেকে আশি সবাই এখন কাবু । এই অসুখের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে অসুখ আরো গাঢ় হবে। নির্দেশকের মুন্সিয়ানায় নাটক দারুণ প্রাণবন্ত লেগেছে।
প্রথম দিনের তৃতীয় নাটক উত্তরণ নাট্য সংস্থার পরিবেশনা – ‘পরিতাপ’। খোয়াই এর অন্যতম নাট্যকার নাট্যনির্দেশক গনেশ দেবরায়ের অনবদ্য রচনা। বিশেষ করে অভিনেতাদের মধ্যে প্রীতম ,নাটকের নায়িকা সরজিত সবাই দারুন অভিনয় করেছে। এই অল্প বয়সে নায়ক নায়িকারা এত সাবলীল প্রেমের দৃশ্য যেভাবে অভিনয় করেছে তাতে সত্যিই দর্শকদের মাতিয়ে দিয়েছে।
দ্বিতীয় দিনের প্রথম নাটক খোয়াইয়ের অন্যতম নাট্য দল শুভম নাট্যচক্র পরিচালিত – ‘আজও অঞ্জনারা’ বাল্যবিবাহ রোধে এক জোরালো প্রতিবাদ নিয়ে হাজির হয়েছে। নাটকে অঞ্জনার মা (শ্রাবণী) অসাধারণ অভিনয় করেছে। বিষয়টি একেবারে বাস্তব এবং এই ধরনের সুন্দর বক্তব্য ধর্মী নাটক ত্রিপুরার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া অত্যন্ত দরকার ।
দ্বিতীয় দিনের দ্বিতীয় নাটক শুভম নাট্য চক্রের প্রযোজনায় – ‘এসো শপথ করি’ নেশার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে দিয়েছে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে যে নেশা কারবারীর কাছ থেকে নেশা সামগ্রী নিয়ে ঘরে ঘরে শিশুরা ধ্বংস হচ্ছে সেই নেশা কার বাড়ির ছেলেই যখন নেশার করাল গ্রাসে তলিয়ে গেছে তখন সে জীবনের পরম সত্যিটা বুঝতে পেরেছি। নাটকটির বক্তব্য অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এই নাটকটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। অভিনয়ের পীযূষ কান্তি চৌধুরী শিবব্রত রায় সহ অন্যান্যরা দারুন ভাবে মঞ্চকে মাতিয়ে রেখেছেন।
দ্বিতীয় দিনের তৃতীয় নাটক আগরতলার রাঙ্গামাটি নাট্য ক্ষেত্রের ‘শঠে শাঠ্যং’ । উত্তম দাস পরিচালিত এই নাটকটি নাট্যোৎসব টিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। আসলে সমাজে এখন মিথ্যা ভ্যকধারী মেকি বিদ্বানদের রমরমা চলছে। প্রকৃত সাত্ত্বিক ব্যক্তিকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না। এটাই তো কলির যুগের ধর্ম। এই চরম বাস্তবতার মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে উত্তম দাসের পরিকল্পনায় একটি অসামান্য নাটক আমরা উপভোগ করি। নাটকের রূপসজ্জা, মঞ্চসজ্জা আবহ সবকিছুই ছিল দারুন । বিশেষ করে উত্তম দাস, তার শিষ্য, গ্রামবাসী, থেকে শুরু করে সবার অভিনয় ছিল দুর্দান্ত। সেই সঙ্গে হিন্দু ঠকবাজ থেকে মুসলমান ঠকবাজ হওয়ার দৃশ্যটি সবাইকে মাতিয়ে দিয়েছে। আর সবশেষে সত্যের জয় ঘোষণা করে পরিচালক নাটকের জয় ঘোষণা করেছেন।
দ্বিতীয় দিনের শেষ নাটক খোয়াই সরকারী দ্বাদশ শ্রেণী বিদ্যালয় এর প্রযোজনায় প্রিয়ঙ্কর দাসের নির্দেশনায় নাটক – ‘আমাদের কি হবে’। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আমরা পিতা মাতারাই মোবাইল ফেসবুক ইউটিউব ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদির প্রতি এমনভাবে ঝুঁকে আছি যে আমরা নিজেরাই নিজেদের কে আনন্দ দিতে গিয়ে ছেলেমেয়েদের হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছে। এই মারাত্মক সমস্যার বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে প্রিয়ঙ্করের নাটকে। অভিনেতারা রাত্র পৌনে এগারো টার সময় যে ধরনের এনার্জি এবং মুন্সিয়ানা নিয়ে নাটক করেছে এটা বোধহয় খোয়াই বলেই সম্ভব হয়েছে ।
শেষ দিনের প্রথম নাটক নাট্য সংসদের প্রযোজনায় পরিবেশিত হয় নাটক ‘সংস্কার সংস্কৃতি’। বিশেষ করে একটি ওয়ার্কশপ সিস্টেম নাটক। গ্রীষ্মের অবকাশের শেষ দিনে স্যারেরা ছাত্রছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য অনেক কিছু বলেন ছুটিতে অমুক করবে, তমুক করবে। এইসব ভাবনাকে নিয়ে সৌরভ দাস খুব দারুণভাবে নাটকের নির্মাণ করেছেন। নাটকের সবচেয়ে ভালো লেগেছে যে দিকটা সেটা হল ১০-১২টা ছেলেমেয়ে মিলে একসাথে আড্ডা দেওয়া, এটা ছোটরা কেন আমরা বড় রায় ভুলে গেছি ।যখনই আমরা কথা বলতে বসি হাতের মোবাইল খানা মাঝপথে এসে নর্তকীর মত নৃত্য শুরু করে দেয়। এখানে মঞ্চের মধ্যে ছাত্র-ছাত্রীরা নাট্য অভিনয়ের ঊর্ধ্বে উঠে গল্প করতে বসেছে এবং গল্পের ছলে রামায়ণ-মহাভারত এবং আমাদের সংস্কৃতির চর্চা করে গেছে। যে ভঙ্গিমায় তারা চর্চা করেছে এটা যে কোন শিক্ষক তার বিদ্যালয়ে প্রয়োগ করে দেখাতে পারেন আশা করি ছাত্রছাত্রীরা অনুপ্রাণিত হবে বলে মনে করি। অভিনেতারা দারুন ছিল।
এরপর উত্তমালোকের প্রযোজনায় উৎসব চক্রবর্তীর পরিবেশনায় পরিবেশিত হয় শ্রুতি নাটক ‘ইন্দু বাবুর কপাল’। অর্থের লালসা আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কিভাবে ব্যবসায়িক সম্পর্কে নিয়ে দাঁড় করায় তার একটি জলজ্যান্ত প্রমাণ এই শ্রুতি নাটক। কনসেপ্ট খুবই ভালো আবৃত্তিকারেরা দারুন দক্ষতা দিয়ে শ্রুতি নাটকটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে।
নাট্যোৎসবের শেষ পরিবেশনা ছিল নাট্য সংসদের প্রযোজনায় নৃত্যনাট্য ‘নটীর পূজা’। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিসংবাদিত সৃষ্টি নটীর পূজা হীরেন্দ্র স্যারের আশীর্বাদে নাট্য সংসদের কুশীলবেরা যেভাবে উপস্থাপন করেছে আশা করি খোয়াইয়ের দর্শকেরা বহুদিন তা মনে রাখবেন। নাচে গানে কথায় একেবারে অনবদ্ধ সৃষ্টি। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখার মত। নাট্য সংসদের শিল্পীরা অপূর্ব দক্ষতায় পুরোটাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। শ্রীমতির চরিত্রে অভিনয় কারিণী ভবিষ্যতে খোয়াইয়ের গর্ব হবেন বলে মনে করা হচ্ছে। গানে সুস্মিতা এবং তার সহ শিল্পীরা, ভাষ্যে উৎসব, পূরবী সৌরভ, তবলায় তন্ময়, দেবু এবং দিব্যের দারুন সঙ্গত আর সুজিত দাসের নির্দেশনা আমরা এক অপূর্ব নৃত্যনাট্য উপভোগ করলাম।
সবশেষে একটা কথাই বলব খোয়াইয়ের বুকে আবার নাটকের জোয়ার এনে দিয়ে নাট্য সংসদ আজ সত্যিই জয়ী হয়েছে। যারা এই অসাধ্য সাধনে অক্লান্ত শ্রম দিয়েছেন তাদের প্রতি রইল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। নাটক দীর্ঘজীবী হোক। খোয়াই নাট্যসংসদ পরিচালিত এই তিন দিনের নাট্যোৎসব যে সফলতা পেয়েছে সবটাই খোয়াই এর নাট্য প্রমি দর্শকদের জন্য। নাট্য সংসদ আয়োজিত তিনদিন ব্যাপী নাট্য উৎসবের ব্যাপকভাবে সফলাতা এনে দেবার জন্য সংস্থার পক্ষ থেকে এক প্রেস করে সংস্থার সম্পাদক সুরজিৎ গোপ খোয়াই এর সমস্ত খোয়াই বাসি ও নাট্য প্রেমি দর্শকদের সুভেচ্ছা জানান।