মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর (ডা.) মানিক সাহার সভাপতিত্বে আজ রাজ্যে বন্যাজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে এক সর্বদলীয় বৈঠক রাজ্য অতিথিশালায় অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে রাজ্যের প্রধান প্রধান সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃবন্দগণ উপস্থিত থেকে রাজ্যের এই সামগ্রিক বিপর্যয়ে রাজ্যে সরকারের পাশে থেকে সর্বোত সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। বৈঠকে শুরুতে বন্যায় নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ২ মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। সর্বদলীয় সভায় বিরোধী দলনেতা জীতেন্দ্র চৌধুরী ছাড়াও প্রদেশ বিজেপি দলের পক্ষে সভাপতি রাজীব ভট্টাচার্য, সিপিআইএম দলের পক্ষে প্রাক্তন মন্ত্রী মানিক দে ও রতন ভৌমিক, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পক্ষে প্রদেশ সভাপতি আশীষ কুমার সাহা ও বিধায়ক সুদীপ রায়বর্মণ, তিপরা মথা দলের পক্ষে রাষ্ট্রমন্ত্রী বৃষকেতু দেববর্মা, রাজেশ্বর দেববর্মা ও বিধায়ক রঞ্জিত দেববর্মা, সিপিআই দলের পক্ষে ডা. যুধিষ্ঠির দাস ও মিলন বৈদ্য, ফরোয়ার্ড ব্লকের রঘুনাথ সরকার ও জয়ন্ত দত্ত, আরএসপি দলের দীপক দেব, আমরা বাঙালি দলের গৌরাঙ্গ রুদ্র পাল ও দুলাল ঘোষ এবং আইপিএফটি দলের পক্ষে সিন্ধুচন্দ্র জমাতিয়া ও প্রশান্ত দেববর্মা উপস্থিত ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী সর্বদলীয় বৈঠকের শুরুতে রাজ্যে গত ১৯ আগস্ট থেকে ভারী ও অবিশ্রান্ত বর্ষনের ফলে যে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তার সংশ্লিষ্ট তথ্য সভায় তুলে ধরেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, সকলের সম্মেলিত প্রচেষ্টায় এই দুর্যোগ কাটিয়ে উঠা সম্ভব হবে। বন্যায় এখন পর্যন্ত ২৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন, ২ জন নিখোঁজ এবং ২ জন আহত হয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী জানান, বন্যায় মৃত প্রত্যেকের নিকট আত্মীয়কে বিপর্যয় মোকাবিলা তহবিল থেকে ৪ লক্ষ টাকা ও আহতদের ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলায় সমস্ত ধরণের সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। রাজ্যের প্রায় সবকয়টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাজ্যের অধিকাংশ নদীগুলির জলস্তরে বিপদ সীমার উপর দিয়ে বয়ে গেছে। ১৯ আগস্ট ভারী বর্ষণের পর থেকে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলা এবং ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যের জন্য প্রতিনিয়ত পর্যালোচনা বৈঠক করা হয়েছে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে হেলিকপ্টার ও এনডিআরএফ চাওয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ৪টি হেলিকপ্টার এবং ১১টি এনডিআরএফ দল পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি এসডিআরএফ, আপদা মিত্র, আসাম রাইফেলস, সিভিল ডিফেন্সসহ বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার স্বেচ্ছাসেবীগণ ত্রাণ ও উদ্ধার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। সর্বদলীয় সভায় মুখ্যমন্ত্রী জানান, সারা রাজ্যে ৫৫৭টি ত্রাণ শিবির খোলা হয়েছিল। এইসব শিবিরগুলিতে ১ লক্ষ ২৮ হাজার দুর্গত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে প্রাপ্ত সংবাদ অনুসারে প্রায় ১৭ লক্ষ লোক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বন্যা কবলিত স্থান সমূহে তিনি নিজেও সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। এবারের বন্যার ভয়াবহতা এতই বেশী যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান আরোও বাড়তে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেন। এখন পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, কৃষি জমি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং ১ লক্ষ ৪০ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ট্রান্সফরমার এবং ২টি বিদ্যুতের সাব ডিভিশন সম্পূর্ণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২৩২ ৪টি জায়গায় ভূমিধুস সরানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন পর্যন্ত কৃষিক্ষেত্রে ১৬ লক্ষ হেক্টর বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ১৬০৩টি খুঁটি, ৫০১টি ২৫৪৪টি স্থানে ভূমিধস পড়েছিল। তারমধ্যে এছাড়াও ২০৬৬টি জায়গায় ভূমিধুস হয়েছে। ২০০ জন প্রকৌশলী দিনরাত ভূমিধুস সরানো সহ নানা কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী শিবিরগুলির শৌচালয়ের পরিচ্ছন্নতা, দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বণ্টন, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা সামগ্রী প্রদান প্রভৃতি বিষয় সরকারের নজরদারিতে রয়েছে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্য শিবির চালু করা হয়েছে।সর্বদলীয় বৈঠকে বিরোধী দলনেতা জীতেন্দ্র চৌধুরী আলোচনায় অংশ নিয়ে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এই বৈঠক আহ্বান করার জন্য মুখ্যস্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। তিনি পরিস্থিতির মোকাবিলায় রাজ্য সরকারের কাছে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করেন। শ্রী চৌধুরী বলেন, এই বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার। গ্রামেগঞ্জে যাতে ভূমিধস না ঘটে তারজন্য ভবিষ্যতে আলোচনা প্রয়োজন। রাজ্যে যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপনে বাড়ী বাড়ী থেকে মূল্যায়ন করতে প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে তিনি অনুরোধ জানান। রাজ্যের সার্বিক ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের এক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল যাতে রাজ্যের বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে তারজন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করতে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষন করেন। এছাড়াও বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা জারী ও প্রস্তুতি বিষয়টি তুলে ধরেন। সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি রাজ্য সরকারের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়, তারপরেও যাতে যথাসম্ভব প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দিতে শ্রীচৌধুরী রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষন করেন।সর্বদলীয় বৈঠকে আলোচনাকালে বিধায়ক সুদীপ রায়বর্মণ রাজ্যের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরে প্লাস্টিক ও ফ্ল্যাক্স ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরো জোরদার করার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। রাজ্য থেকে একটি সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে কেন্দ্রীয় অর্থ সাহায্যের জন্য প্রেরণ করতে তিনি প্রস্তাব দেন। এছাড়াও ক্ষতিপূরণ নিরূপনের ক্ষেত্রে তিনিও বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপন করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সর্বদলীয় সভায় সি পি আই এম দলের পক্ষে প্রাক্তন মন্ত্রী মানিক দে আলোচনায় অংশ নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পুনঃনির্মাণ, শিবিরে অবস্থানরত মহিলাদের নিরাপত্তা, রেগা ও টুয়েপের মাধ্যমে অতিরিক্ত শ্রমদিবস সৃষ্টি করে ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর পরিচ্ছন্নতার কাজে নিয়োজিত করার পরামর্শ দেন। আলাদাভাবে প্রাণী বিকাশ সম্পদ দপ্তর ও মৎস্য দপ্তরের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপন করতে তিনি সভায় প্রস্তাব দেন। যারা ত্রাণ শিবিরে আসতে পারেনি সেই সব দূর্গত মানুষদের কাছেও ত্রাণ সামগ্রী যাতে পৌঁছানোয় সে বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ত্রিপুরা প্রদেশ বিজেপির সভাপতি রাজীব ভট্টাচার্য বন্যা পরিস্থিতির মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত রাজ্য সরকার যেসমস্ত উদ্যোগ নিয়েছে এবং যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রশাসনের সকলস্তরের কর্মচারীগণ এই পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করছেন তার জন্য তিনি সকলকে ধন্যবাদ জানান। রাজ্যের হাসপাতালগুলিতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা সচেষ্ট রাখতে তিনি পরামর্শ দেন। এছাড়াও রাজ্যের বাঁধগুলির রক্ষনাবেক্ষণ ও নাগরিক সচেতনতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি শিবিরগুলিতে আশ্রিত পশুদের প্রয়োজনীয় পশু খাদ্য সরবরাহ অক্ষুন্ন রাখতে পরামর্শ দেন। প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি আশিস কুমার সাহা আলোচনাকালে সকল দুর্গতদের কাছে প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছানো সুনিশ্চিত করার আহ্বান জানান। তিনি এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বদলীয় মনোভাবের বার্তা রাজ্যে সর্বত্র পৌঁছে দেওয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিপরা মথা দলের পক্ষে রাষ্ট্রমন্ত্রী বৃষকেতু দেববর্মা কৃষি ও উদ্যানজাত ফসলের ক্ষয়ক্ষতি সহ বিশেষ করে রাবার বাগানের ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়নের উপর গুরুত্ব দিতে সভায় প্রস্তাব রাখেন। সর্বদলীয় সভায় আই পি এফ টি দলের পক্ষে প্রক্তন বিধায়ক প্রশান্ত দেববর্মা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপনের কাজে ভিলেজ কমিটি ও পঞ্চায়েত সচিবদের মাধ্যমে করার বিসয়ে গুরুত্ব করেন। সর্বদলীয় সভায় আলোচনায় অংশ নিয়ে সিপিআই (এম) দলের পক্ষে রতন ভৌমিক, তিপরা মথা দলের পক্ষে রাজেশ্বর দেববর্মা ও বিধায়ক রঞ্জিত দেববর্মা, সিপিআই দলের পক্ষে ডা. যুধিষ্ঠির দাস ও ফরোয়ার্ড ব্লকের রঘুনাথ সরকার, আরএসপি দলের দীপক দেব, আমরা বাঙালি দলের গৌরাঙ্গ রুদ্র পাল দুর্গত এলাকার নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, কালোবাজারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ, দ্রুত বিদ্যুৎ পরিষেবা চালু, টেলি যোগাযোগ ব্যবস্থা দ্রুত সচল করা এবং এলাকায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রক্ষা বিষয়গুলি উল্লেখ করেন। প্রশাসনকে সর্বতোভাবে সহায়তায় করা হবে বলে রাজনৈতিক দলগুলির পক্ষ থেকে সভায় আশ্বস্ত করা হয়। তাছাড়াও বিভিন্নদলের রাজনৈতিক প্রতিনিধিগণ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয়স্তরেও আজকের মত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিগণের মতামত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সর্বদলীয় সভায় মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর ডা মানিক সাহা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে উত্থাপিত প্রস্তাবসমূহ তাৎপর্যপূর্ণ বলে অভিহিত করেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বিপর্যয় আমাদের হাতে নেই। সামনে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হলেও বিপর্যয় প্রতিরোধে আগামী দিনে আমাদের সকলের আলোচনা করার দরকার। তিনি বলেন, যেসমস্ত প্রস্তাব আজকের বৈঠকে আলোচিত হয়েছে সে বিষয়গুলিকে বিবেচনা করে দেখা হবে।সর্বদলীয় বৈঠকের পর সরকারি অথিতিশালায় এক সংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর (ডা) মানিক সাহা এখন পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য এবং আজকের সর্বদলীয় বৈঠকের আলোচনার বিষয়গুলি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, চন্দ্রপুর নাগেরজলা বাসস্ট্যান্ড থেকে পুনরায় বাস পরিষেবা চালু হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের পাঠ্য পুস্তক ও শিক্ষা সামগ্রী প্রদানের জন্য শিক্ষাদপ্তরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিক সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী জানান, রাজ্যে পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী ও জ্বালানী মজুত রয়েছে। এবিষয়ে অহেতুক বিভ্রান্তির কোন কারণ নেই। স্বল্প সময়ের আহ্বানে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও প্রতিনিধিগণ এই বৈঠকে অংশ নেওয়ায় জন্য মুখ্যমন্ত্রী সবাইকে ধন্যবাদ জানান। সর্বদলীয় সভায় মুখ্যমন্ত্রীর সচিব ড. পি কে চক্রবর্তী, রাজস্ব দপ্তরের সচিব ব্রিজেশ পান্ডে ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ আধিকারিকগণ উপস্থিত ছিলেন।