তেলিয়ামুড়া প্রতিনিধি গোপেশ রায় ঃ- নতুন বছরের আগমন নিয়ে বাতাসে মিশে যায় উচ্ছ্বাসের সুর। প্রিয়জনদের সঙ্গে হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া শুভেচ্ছা বিনিময়ের এই অনন্য উপলক্ষে একসময় ডাকঘরগুলো হয়ে উঠত উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। হাতে লেখা চিঠি, রঙিন গ্রিটিংস কার্ডের স্তূপ, ডায়েরির পাতায় আঁকা ফুল-পাখি আর ভালোবাসার বার্তা—সেই যুগের স্মৃতি আজ প্রযুক্তির ঝড়ে ধুমিল হয়ে আসছে। কিন্তু সেই উষ্ণতার ছোঁয়া কি সত্যিই হারিয়ে গেছে, নাকি নতুন প্রজন্ম আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছে?
এক-দশক আগেও নববর্ষ মানেই ছিল এক অলৌকিক প্রস্তুতি। স্থানীয় বাজার থেকে সেরা গ্রিটিংস কার্ড বেছে নেওয়া, তার ওপর নিজের হাতের কলমে শুভকামনা লেখা, সুন্দর খামে ভর্তি করে ডাকপিয়নের হাতে তুলে দেওয়া। দিন কয়েক পর ঠিক সময়ে পৌঁছে যাওয়া সেই চিঠি প্রাপকের মুখে ফুটিয়ে তুলত অমূল্য হাসি। প্রতিটি অক্ষরে, প্রতিটি বাঁকা লাইনে মিশে থাকত প্রেরকের মনের গভীর অনুভূতি—যা কোনো মেশিন তৈরি করতে পারে না। রাজ্যের এক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ৭৫ বছরের শান্তিদেব রায় স্মৃতি তুলে বলছেন, “ছেলেবেলায় আমরা নিজেরাই কার্ড বানাতাম। রঙিন কাগজে গ্লু দিয়ে ফুল-পাখি আঁকা, তার ওপর লাল কালিতে লেখা ‘নতুন বছরের অনেক অনেক অভিনন্দন’। সেই চিঠি পৌঁছালে দূরের মামা-মামীর চোখে জল চিকচিক করত। আজকের ইমোজি-ভরা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে সেই উষ্ণতা কোথায়?”স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে ডাকঘর ছিল সমাজের হৃদয়স্পন্দন। নববর্ষে ডাকঘরের সামনে লম্ব লাইন, চিঠি তৈরির জন্য বিশেষ খাতা বিক্রি। বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকরাও চিঠির মাধ্যমে শুভেচ্ছা পাঠাতেন। রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র আজও সাহিত্যের রত্ন। সেই যুগে চিঠি ছিল না শুধু বার্তা, বরং এক সম্পর্কের সেতু—যা সময়ের সঙ্গে গভীরতর হতো।আজকের ডিজিটাল যুগে হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম বা ইমেইলের মাধ্যমে এক ক্লিকে শত শত বার্তা পাঠানো হয়। সময় ও খরচ বাঁচে ঠিকই, কিন্তু আন্তরিকতার সেই অমূল্য স্পর্শ মিলিয়ে যায়। একই কপি-পেস্ট বার্তা বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সকলকে পাঠানো হয়—যাতে ব্যক্তিগত আবেগের কোনো ছোঁয়া নেই। ফলে শুভেচ্ছা হয়ে ওঠে যান্ত্রিক, রুটিন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বলেন, “আমরা এত ব্যস্ত যে আলাদা করে কারো জন্য লিখতে সময় পাই না। কিন্তু দাদু-দিদার হাতের লেখা চিঠি পেলে মন ভরে ওঠে। ওতে থাকে তাঁদের ভালোবাসার প্রতিটি অক্ষর—যা কোনো অ্যাপ দিতে পারে না।”ডায়েরি ছিল একসময় আত্মপ্রকাশের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মাধ্যম। নতুন বছরে নতুন প্রতিজ্ঞা লেখা, স্বপ্নের ছবি আঁকা, প্রিয়জনের জন্য লুকিয়ে রাখা কথা—সব মিলত সেই পাতায়। আজ সেই জায়গা নিয়েছে গুগল কিপ বা নোট অ্যাপ, যেখানে আবেগের চেয়ে কার্যকারিতা প্রাধান্য পায়। ফলে ব্যক্তিগত স্মৃতি হয়ে ওঠে ডিজিটাল ক্লাউডের অংশ—যা যেকোনো সময় মুছে যেতে পারে।প্রবীণ নাগরিকরা একমুখে বলছেন, নতুন প্রজন্ম ফিরে আসুক সেই চিঠি-কার্ডের যুগে। প্রযুক্তি এগুক, কিন্তু হৃদয়ের কথা প্রকাশে হাতের লেখার বিকল্প নেই। ৮০ বছরের হরিপদ সেন, একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী বলছেন, “আজ সবাই বলে ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বা ‘শুভ নববর্ষ’। কিন্তু কেউ বলে না, ‘তোমার এই বছর হোক সুখে-সমৃদ্ধি ভরা, স্বপ্নগুলো পূর্ণ হোক’। এই ব্যক্তিগত স্পর্শটাই ছিল চিঠির আসল সৌন্দর্য।”আশার কথা, নতুন প্রজন্মের মধ্যে জেগে উঠছে পুরনো ঐতিহ্যের প্রতি আকর্ষণ। অনেকে হাতে লেখা কার্ড তৈরি করছেন, ডায়েরি উপহার দিচ্ছেন। এক কলেজের ছাত্রী বলছেন, “এবার মা-বাবা, দাদু-দিদার জন্য হাতের লেখা শুভেচ্ছা পাঠাব। এটাই আমার সবচেয়ে বড় গিফট—ডিজিটাল নয়, হৃদয় থেকে আসা।”প্রযুক্তি জীবন সহজ করেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সহজতার ভিড়ে অনুভবের গভীরতা হারাচ্ছে না যাক। এই নববর্ষে কলম তুলে নিন। লিখুন একটা চিঠি, একটা কার্ড বা ডায়েরির পাতা। কীভাবে শুরু করবেন? রঙিন কাগজ নিন, প্রিয়জনের পছন্দের কথা লিখুন, একটা স্মৃতি যোগ করুন। পাঠান ডাকঘর দিয়ে বা হাতে হাতে দিন। দেখবেন, সেই হাসি ফুটবে আবার—যা কোনো অ্যাপ দিতে পারবে না।



