Thursday, December 25, 2025
বাড়িখবরশীর্ষ সংবাদ২৮ বছর পর জন্মভূমির টানে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ১৬০ পরিবারের...

২৮ বছর পর জন্মভূমির টানে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা ১৬০ পরিবারের ৩০০ জন একত্রিত হল জন্মভূমি খোয়াই সমতল পদ্মবিল এলাকায়।

বাসুদেব ভট্টাচার্যী খোয়াই ১৫ই ডিসেম্বর..…. বিগত ২৮ বছর ধরে জন্মভূমি থেকে দূরে গিয়ে রাজ্য সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করা খোয়াই সমতল পদ্মবিল এলাকার ১৬০ পরিবারের ৩০০ জন নিজ জন্মভূমি সমতল পদ্মবিল এলাকায় জড় হলো গ্রামে আয়োজিত এক মিলন মেলায়। কেন তাদেরকে জন্মভূমি ছেড়ে ২৮ বছর ধরে বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করতে হচ্ছে সেই প্রেক্ষাপটটা জানলে অথবা না জানলে এই লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। উল্লিখিত পরিবারগুলি পরিস্থিতির শিকার হয়ে ২৮ বছর আগে নিজের মাতৃভূমি বা জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। কেন সেই কথাই আসছি। একটা সময় ছিল খোয়াই মহকুমার বিভিন্ন গ্রামগুলি এবং সেই গ্রামগুলিতে বসবাসকারী খেটে খাওয়া কৃষক থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ নিজ নিজ সংসার প্রতিপালনে কৃষিকাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের কাজে নিজেরা ব্যস্ত থাকতো। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর কৃষকরা নিজ জমির বিভিন্ন ফসল গ্রামীন হাটে বিক্রি করে দুটি পয়সা নিয়ে শান্তিতে বাড়িতে ফিরে যেত। কিন্তু ৯০ এর দশকে আবার নতুন করে শান্ত ত্রিপুরাকে অশান্ত করতে এক শ্রেণীর উন্মাদ যুবকরা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় তান্ডব নিত্য শুরু করেছিল মানুষ হত্যা করে। তাদের তাণ্ডব নৃত্য থেকে বাদ পড়েনি খোয়াই মহকুমাও। শুরু হলো বিভিন্ন দিকে আগ্নেয়াস্ত্র বহনকারী উগ্রবাদীদের দ্বারা অপহরণ, ছিনতাই, গণহত্যার মতো নিশংসতা দিন দিন বেড়েই চলেছিল। তখন সালটা ছিল ১৯৯৭ সাল। খোয়াই মহাকুমার বিভিন্ন এলাকাতে উগ্রবাদীরা প্রচন্ড উৎপাত শুরু করে। তাতে করে বিভিন্ন গ্রাম সহ বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ উগ্রবাদীদের কারণে প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ওঠে। তেমনি খোয়াই ব্লকের অন্তর্গত সমতিল পদ্মবিল এলাকার দক্ষিণ পাড়ার প্রায় ১৬০ পরিবার তাদের আত্মরক্ষার তাগিদে নিজের জন্মভূমি ছেড়ে ১৯৯৭ সালে খোয়াই সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বসবাস করতে বাধ্য হয়। শুধু রাজ্য নয় অনেক পরিবার রাজ্যের বাহিরেও চলে গেছে। এই পরিবারগুলো সেখানে গিয়ে নিজের পেটের তাগিদে এবং পরিবারের ভরণ পোষণ করতে যে যেমনভাবে পারে সেই ভাবে বিভিন্ন কাজে যোগদান করে। কিন্তু ফেলে আসা সেই জন্মভূমির কথা কোনভাবেই তারা ভুলতে পারেনি বা পাচ্ছিল না। মাঝেমধ্যে একটি দুটি পরিবার এসে তাদের সেই পুরনো পৈতৃক ভটি দেখে যেত এবং দুঃখ প্রকাশ করত। যেসব পরিবারগুলো সেই জায়গা বা মাতৃভূমি ছেড়ে চলে গিয়েছিল তারা একসাথে মিলিত হবার আর কোনদিন সুযোগ পাচ্ছিল না। শেষে এই গ্রামের যুবকরা একটা পরিকল্পনা করলো তাদের পরিবারের যেসব লোকেরা ১৯৯৭ সালের দাঙ্গায় নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল সেই সমস্ত পরিবার গুলিকে একসাথে করে এক মিলন উৎসবের আয়োজন করবে। যেমন চিন্তা তেমন কাজ বিগত কয়েক মাস ধরে ১৬০ পরিবারের ৩০০ জনের উপর লোকের সাথে একের পর এক যোগাযোগ করে একটি মিলন উৎসবের আয়োজন করে। যে যারা চলে গিয়েছিল তাদেরকে একসাথে মিলিত হতে হবে সমতল পদ্ম বিলে নিজ জন্মভূমিতে। গ্রামের যুবকদের এই অভিনব প্রচেষ্টাকে কেও ফিরিয়ে দিইনি। এই প্রচেষ্টার সম্মান রাখতে ১৬০ পরিবারের ৩০০ জনের উপর লোকেরা এক কথায় রাজি হয়ে গত রবিবার জন্মভূমিতে মিলনমেলায় সবাই একসাথে উপস্থিত হয় একটি মাঠে।দৃশ্যটা দেখতে যেমন ছিল খুবই মধুর, কিন্তু তার মধ্যেও ছিল জন্মভূমিকে হারানোর যন্ত্রণা। যা ঐদিন উপস্থিত সবার চোখে মুখে স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল। এই মিলন মেলার জন্য সমতল পদ্মবিল এলাকার দক্ষিণ পাড়ার যুবকরা এই মিলন মেলাকে সামনে রেখে একটি একটি ব্যানার তৈরি করে । যার নাম রাখা হয়েছিল “”ফিরে দেখা অতীত এবং দক্ষিণ পাড়ার মিলন উৎসব” এই নামাকরণে। শুধু তাই না ২৮ বছরের স্মৃতি মন্থন করতে এই ব্যানারে এও লেখা ছিল মাতৃভূমির টানে সকলকে থাকতে হবে ঐকের বন্ধনে, ভেদা বেদ ভুলে সম্পর্ক হোক সবার ঊর্ধ্বে। এই ধরনের স্লোগান ছিল তাদের তৈরি করা ব্যানারটিতে। এইসব লেখাগুলি দেখে মিলন মেলায় আগত সবাই আবেগ আপ্লুত হয়ে যায়। তার মধ্যে অনেকের মৃত্যু হয়েছে, অনেকে আবার বৃদ্ধ। এই মিলন মেলায় উপস্থিত স্ত্রী পুরুষ শিশু কন্যা,সবাই সমস্ত গ্রামের লোকদের সাথে মিলিত হয়ে সেই পুরনো স্মৃতিগুলি মন্থন করেন। ২৮ বছর ধরে দেখতে না পাওয়া সেই লোকগুলির আবেগ ও যন্ত্রণা সবাই মিলে ভাগাভাগি করে নেয়। ২৮ বছর পর জন্মভূমিতে এসে স্মৃতি মন্থন করতে গিয়ে আগত অতিথিরা নিজেদের আবেগকে সামলাতে পারেননি। এমন ও দেখা গেছে জন্মভূমিতে আগত সমস্ত অতিথিদেরকে এক জায়গায় বসিয়ে গ্রামের বেশ কয়েকজন গৃহবধূরা তাদের উদ্দেশ্যে প্রণাম করছেন। কারণ একসময় ওরা গ্রামের মুরুব্বি ছিল বলেই গ্রামের প্রথা অনুযায়ী এই প্রণাম জানিয়ে তাদেরকে সম্মান প্রদর্শন করা হয় করা হয়। এই মিলন উৎসবকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য যুবকদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সমতল পদ্মবিল এলাকার সমস্ত এলাকাবাসী। শেষে সমতল পদ্মবি এলাকায় আগত সমস্ত অতিথিদের কে নিয়ে একটি চড়ুইভাতির ব্যবস্থা করে এলাকার যুবকরা। যদিও মিলন উৎসব শেষে আগত অতিথিরা রবিবার সন্ধ্যায় নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে ফিরে যায়। ওরা শুধু ফিরে যায়নি মাতৃভূমি থেকে ২৮ বছর ধরে দূরে থাকা সেই মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে গ্রামের লোকদের বুক ভরা ভালবাসা ও সম্মান নিয়ে ফিরে গেল পরিযায়ী অতিথিরা আবার কোন এক মিলন মেলার আকাঙ্ক্ষা নিয়ে । তবে যাবার পথে আগত অতিথিরা সমতল পদ্ম বিল এলাকার এই অনুষ্ঠানের আয়োজিত সমস্ত যুবকদেরকে হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে ব্যাপক পরিমাণে আশীর্বাদ করে যান। এই সংবাদের একজন প্রতিবেদক হয়ে একটা কথা স্বীকার করতে হচ্ছে যদি রবিবার এই মিলন মেলা অনুষ্ঠানে উপস্থিত না হতাম তাহলে হয়তো একটা আফসোস থাকতো এই ধরনের মিলনমেলা দেখতে না পাওয়ার। যদিও এই ধরনের মিলন মেলা বা এত বড় মিলন উৎসব কোনদিন দেখিনি। তবে গ্রামের যুবকরা একটি অসাধ্য কাজকে সাধ্য করে দেখিয়ে দিল। এক জন প্রতিবেদক হয়ে সেই মিলনমেলার এক সাক্ষী হয়ে রইলাম।

RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

6 − three =

- Advertisment -spot_img

জনপ্রিয় খবর

সাম্প্রতিক মন্তব্য