আধুনিকতা আর ইন্টারনেট যুগের উৎকর্ষতায় বর্তমানে ছনের ঘর বিলুপ্তির পথে বললেই চলে। মাত্র কয়েক বছর আগেও গ্রাম পাহাড়ের আনাচে কানাচে হলেও দু’চারটি ছনের তৈরি ঘর চোখে পড়ত। বর্তমানে কয়েকটি প্রত্যন্ত পাহাড়ের জনপদ এলাকা গুলিতে ছাড়া অন্য কোথাও সবুজ পাহাড়ে ধূসর রঙের ছনের চালার ঘর এখন আর তেমনটা চোখে পড়ে না। রোদে চিকচিক করা রূপালি ঢেউটিনের চালা বহুদূর থেকেই জানান দেয় তার সতন্ত্র অস্তিত্বের কথা। আর হাজার বছরের পরম বন্ধু অভিমানি ‘ছন’ সন্তর্পণে নিজের অস্তিত্ব বিলিন করে চলেছে।ঢেউটিন এবং পাকা দালান ঘর শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে পাহাড় সর্বত্রই দিন দিন ঘর বাড়ছে। ফলে নতুন করে ছনের ঘর খুব কম হচ্ছে। আবার ছনের ঘর সংস্কারও হচ্ছে খুব কম। তবে পাহাড়ি জনপদ গুলিতে এখনো ছনের ঘর লক্ষ্য করা যায়। এমন চিত্র প্রত্যক্ষ করা গেল তেলিয়ামুড়া মহকুমার মুঙ্গিয়াকামী আর.ডি ব্লকের অধীন আঠারো মুড়া সহ বিভিন্ন উপজাতি এলাকা গুলিতে। তবে অধিকাংশ সময়েই লক্ষ্য করা গেছে বেশিরভাগ ছনের ব্যবহার বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকায়। জুমিয়া পরিবার গুলিকে জুম চাষের জমিতে ছন বাঁশ দিয়ে টং বানাতে দেখা যায়। কিন্তু ছনের ব্যবহার বিগত দিনগুলি তুলনায় বর্তমানে খুবই কমে গেছে। আঠারো মুড়া পাহাড়ের জঙ্গলে ছনের উৎপাদন খুবই কম। আর যা পাওয়া যায়, তাও পাঁচ গুণ দামে কিনতে হয়। এমনকি এমন অনেক পরিবার ছিল যারা ছন বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু পাহাড়ের জঙ্গলে ছনের উৎপাদন কম হওয়াতে অনেক ছন ব্যবসায়ীরা ছন বিক্রির ব্যবসাও ছেড়ে দিয়েছে। বিগত দিনগুলিতে ডিসেম্বর মাস থেকে হাট-বাজারে ছন আসা শুরু হত। শীতকাল শুরু হতে গ্রামীণ-পাহাড়ি এলাকা থেকে শুরু করে শহরের ঘর বাড়িতে ছাউনি হিসাবে ছনের ব্যবহারের ধুম পড়ে যেত। প্রায় পরিবারই ছিলো তখন ছনের উপর নির্ভরশীল। এইতো কয়েক বছর আগেও, বছর গত হলেই, ঘরের ছাউনিতে ছনের প্রয়োজন হত পাহাড়ি জন পদ সহ গ্রামীণ এলাকাগুলিতে। গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত উপজাতি জনপদ এলাকার লোকেরা জ্বালানি এবং গরু-মহিষের খাদ্য হিসাবে ছন ব্যবহার করতো। কিন্তু কালক্রমে গরীবের ছাউনি সেই ছন হারিয়ে যেতে বসেছে। এ বিষয়ে এক উপজাতি ব্যক্তি জানান, বিগত দিনগুলিতে আঠার মুড়া পাহাড়ে ছন পাওয়া যেত অহরহ। এই ছনের উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে জানা গেছে, পাহাড়ের জঙ্গলে এখন আর সেরকম ছন পাওয়া যায় না। বহু গভীর জঙ্গল থেকে ছন সংগ্রহ করতে হয়। একই পাহাড়ে ফলজ ও বনজ গাছের পাশাপাশি ছনও হত। বিভিন্ন কারণে পাহাড় ধ্বংসের কারণে এবং রীতিমত পাহাড় পরিষ্কার না করার কারণে পাহাড়ে ছন বিলুপ্ত হতে যাচ্ছে। পর পর দু‘বার ছন না কাটলে সেই পাহাড়ে আর ছন হয় না। প্রতি বছর ছন কাটলে এবং আগাছা পরিষ্কার করে দিলে ছনের ভালো উৎপাদন হয়। আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত ছন আহরণ করা হয়ে থাকে। চাষাবাদে তেমন পরিশ্রম নেই। শুধুমাত্র পাহাড়ের যে অংশে ছন চাষ করা হবে তা পরিষ্কার করে দিলেই কিছুদিন পর প্রাকৃতিক ভাবেই ছনের কুঁড়ি জন্ম নেয়। এরপর ছনের দৈর্ঘ্য দেড় দুই হাত হলে আগাছা পরিষ্কার করে একবার ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়। আর ৬-৭ ফুট লম্বা হলেই কাটার উপযুক্ত হয়। আহরণের পর পর্যাপ্ত রোদে ১৫ থেকে ২৫ দিন শুকিয়ে নিলে এরপরই তা ব্যবহার উপযোগী হয়। আরো জানা যায়, আজ থেকে বিশ-পঁচিশ বছর আগেও শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ছনের ছাউনির ঘর ছিল। কারণ, আশপাশ এলাকায় পাওয়া যেত প্রচুর পরিমাণে ছন যা ব্যবহার করা হতো ঘরের ছাউনি ও পানের চাষের জন্য বরের কাজে। নিম্নবিত্তের মানুষ এই ছন দিয়ে ঘরের ছাউনি দিতো। এছাড়া কাঠুরিয়ারা ছন বিক্রি করে সংসার চালাতো। স্থানীয়ভাবে গরীবের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর বলে পরিচিত ছিল এই ছনের ছাউনির ঘর। উচ্চবিত্তরাও শখের বসে পাকা ঘরের চিলে কোটায় ছন ব্যবহার করতো। আরো জানা গিয়েছে, বছর কয়েক আগেও ছন বাশ ব্যবহৃত ঘর বানাতে প্রায়শই লক্ষ্য করা যেত। কিন্তু বর্তমানে ছনের ছাউনির পরিবর্তে টিনের ছাউনি দিতে দেখা যায় পাহাড়েও। শীত ও গরম উভয় মওসুমে আরামদায়ক ছনের ছাউনির ঘর। ছনের ছাউনি ঘর নির্মাণের জন্য বেশ কিছু কারিগর ছিল। তাদের মজুরি ছিল ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। বিশেষ কায়দায় ছনকে সাজিয়ে কয়েকটি ধাপের মাধ্যমে ছাউনি দেয়া হতো। ছাউনির উপরে বাঁশ ও বেত দিয়ে শক্ত করে বেঁধে জল ছিটানো হতো। যাতে করে সহজে ছনগুলো বাঁশের উপর বসে যায়। কিন্তু আধুনিকায়নের সাথে সাথে এখন ছনের উৎপাদন যেমন কমেছে তেমনি ছনের ঘরের চাহিদা কমে গেছে। কারণ, মানুষ এখন আর বাঁশ-ছন দিয়ে ঘর তৈরি করতে চায় না। বাঁশ ও ছন দিয়ে তৈরি ঘরগুলো বেশি দিন টেকশইও হয় না। প্রতি বছর মেরামত করতে হয়, যার কারণে ছনের চেয়ে বেশি চাহিদা বেড়েছে এখন টিন এবং পাকা ঘরের। তাই ছনের ঘরের পরিবর্তে এখন দখল করে নিয়েছে টিন এবং সিমেন্ট-ইট-বালির ঘর। বোঝা প্রতি মাত্র ৫০ টাকা থেকে ৮০ টাকায় পাওয়া যায় ছন। তবে বর্ষা মৌসুম এলে ছনের চাহিদা বেশি থাকে। বর্তমানে ছনের চাহিদা গ্রাম ও শহরে তেমন নেই। কিন্তু পাহাড়ি জনপথ গুলিতে এখনো লক্ষ্য করা যায় ছনের ব্যবহার। বর্তমানে ছনের উৎপাদন ও ব্যবহার কমে যাওয়ায় এটি এখন বিলুপ্তির পথে। বছর বছর ছন ক্রয় করে চালা মেরামতের পেছনে অর্থ ব্যয় না করে সবাই কমদামী ঢেউটিন ব্যবহারে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ছন থেকে উন্নতমানের সুতা ও দড়ি উৎপন্ন হয়। একসময় শহরেও ছন বিক্রি করতে দেখা যেত কিন্তু কালের বিবর্তনে সেই দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। তাই হারিয়ে যাচ্ছে ছনের ব্যবহার। আধুনিক সভ্যতায় মানুষ এখন পাকা-আধাপাকা বাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত। ছাউনি হিসাবে ব্যবহার করছে টিনকে। ফলে ছনের ব্যবহার ক্রমশ বিলুপ্তির পথে। তবে বিশেষজ্ঞ মহল মনে করেন, ছন দিয়ে নানাবিধ ব্যবহার বাড়ানো গেলে হয়তো ছনের ব্যবহার বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখা সম্ভব হতো এবং ছন চাষ করে অনেক চাষীরাই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতো।।



