বাসুদেব ভট্টাচার্জী খোয়াই ২১ শে ডিসেম্বর……. গত এক যুগ ধরে নাট্য চর্চার আঙ্গিনায় খোয়াই শহরের নাট্য চর্চা অনেক দিক থেকে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। যদিও এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। বর্তমান সময়ে ইন্টারনেটের যুগে নাট্যচর্চা এবং নাটক দেখা একেবারে শিখিয়ে উঠেছে। অন্য দিক দিয়ে সাংস্কৃতিক শহর হিসেবে পরিচিত খোয়াই শহরের নাম নাট্য চর্চার দিক দিয়ে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিল। সেই সুনামের ফলে আজও খোয়ায় শহরকে সাংস্কৃতিক শহর, ও নাট্য চর্চার শহর হিসেবে পরিগণিত হয় । যদিও আজকাল এই নাট্য চর্চার দিক দিয়ে আগেকার মতন উৎসাহিত হয়ে নাটক করে নিজের প্রতিভাকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে তেমন প্রতিভার লোক এই সাংস্কৃতিক জগতের সাথে একেবারেই যুক্ত হয় না বলেই চলে। কারন এটাতে কোন ভবিষ্যৎ নেই যা এক এক বাস্তব সত্য কথা। এরপরও মানুষ নাটক দেখতে চায়, যদি না সেই পরিমাপের নাটক দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করা যায় বর্তমান সময়ে। আজকাল স্থানীয় পান্ডুলিপি রচনাকারিদের খুবই অভাব। এরপর ও নাট্য চাচার দিক দিয়ে খোয়াই শহরের তিনটি নাট্য সংস্থা নাট্য চর্চার আন্দোলনকে গুটু গুটি পায়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে বর্তমান সময়ের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করেই। যদিও আজকাল নাটকের দর্শক খুঁজে পাওয়া খুবই মুশকিল। এক ঘন্টা বা দেড় ঘন্টা নাটক না দেখে মানুষ মোবাইল ইন্টারনেটে এন্টারটেইনমেন্ট করে নেবে ওটা তাদের কাছে মন খুশি করার সহজ রাস্তা এবং এই পথে সবাই হাঁটছে। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে গত কয়েক দিন আগে শুভম নাট্যচক্রের রজত জয়ন্তী উপলক্ষে খোয়াই পুরাতন টাউন হলে আয়োজিত হল তাদের নাটক “তদন্ত সংবাদ”। ২২শে ডিসেম্বর আগরতলায় একটি রাজ্য ভিত্তিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে শুভম নাট্যচক্রের “তদন্ত সংবাদ” নাটকটি। তাকে কেন্দ্র করেই বুধবার সন্ধ্যায় খোয়াই পুরাতন টাউন হলে শুভম নাট্য চক্রের রজতজয়ন্তী কে সামনে রেখে অনেকদিন পর সংস্কৃতির শহর খোয়াইয়ের নাট্য পরি মন্ডলে নাটকের কিছুটা প্রাণ ফিরে পেল খোয়াইয়ের নাট্যমোদি দর্শকরা। নাটক দেখতে এই দিন কানায় কানায় পরিপূর্ণ ছিল খোয়াই পুরাতন টাউন হলটি। ঐ দিন সন্ধ্যায় প্রথমে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। এর পরবর্তীতে চারজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয় শুভম নাট্যচক্রের পক্ষ থেকে। উক্ত অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন বিধায়ক পিনাকী দাস চৌধুরী, এছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন খোয়াই পুর পরিষদের চেয়ারম্যান দেবাশীষ নাথ শর্মা, শুভম নাট্যচক্রের অন্যতম সদস্য তথা বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সমীর কুমার দাস, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সুব্রত মজুমদার, বিজয় কুমার দেবনাথ, তাপস দাস সহ অন্যান্যরা। পরবর্তী সময়ে শিব শর্মার রচনায় এবং শিবব্রত রায়ের পরিচালনায় “তদন্ত সংবাদ” নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এই নাটকে চৌকিদারের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন অভিনেতা তথা খোয়াই পুর কাউন্সিলর পীযুষ কান্তি চৌধুরীর অভিনয় থেকে শুরু করে সমস্ত কলা কুশীলবদের অভিনয় সকলের মন কেড়ে নিলেও নাটকটিতে কিছু খামতি দেখা গেছে। নাটকের প্রথম দৃশ্যে চৌকিদার একটি হারিকেন নিয়ে ডাকবাংলাতে প্রবেশ করে। বয়সের ভারে একটু গুজু হয়ে গেছেন উনার হাতে একটি লাঠি থাকলে ভালো হতো যে ভঙ্গিমায় তিনি অভিনয় করেছেন । হাতে লাঠি থাকাটা মানে উনার বয়সের ভারে যে গুজু হয়ে গেছেন সেটার ক্ষেত্রে দেখতে ভালো লাগতো। আর এই বয়সে ওনার গলার স্বরটা আরেকটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা হলে বা কম্পন হচ্ছে কথা বলতে তাহলে আরো সুন্দর হতো । একজন বয়স্ক মানুষ এত জোরে চিৎকার দিয়ে কথা বলতে গেলে নাটকের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে যায়। তাছাড়া গ্রামের একটি ডাকবাংলা সেটা বোঝার কোন উপায় ছিল না নাটকের কুশীলবদের কথোপকথন ছাড়া। দ্বিতীয় পর্যায়ে আরেকজন আসে এক যুবক হয়তো একটু নেশার বিষয়ে চৌকিদারের সাথে উচ্চস্বরে কথোপকথন হয়। তাতেও তাদের গলার স্বর অনেকটা হারিয়ে যাচ্ছিল অতিরিক্ত উচ্চ স্বরের কারণে। আর তাতে করে মঞ্চে ডায়লগ বলতে গিয়ে উভয়েই মঞ্চের লাইট “জোন” থেকে স্বরে আসতে দেখা গেছে। এখানে বোঝা যাচ্ছে মঞ্চে তাদের লাইট নিয়ে রিহার্সালটার একটু খামতি রয়েছে বারবারই “জোনের” আলো থেকে সরে আসছিল এবং অর্ধেক লাইট ধরে কথা বলছিল। এরপর আসে এক অভিনেতা যে ওই ডাক বাংলো এলাকায় ভয়ের সঞ্চার হয়েছে সেই ভাইয়ের খবর নিতে বা তদন্ত করতে নাটকের কুশিলব হিসেবে পরিচালক শিবব্রত রায় শহর থেকে। সেই হিসেবে ওনার জামা কাপড় ঠিকঠাকই ছিল । ভায়ের খবর শুনে তিনি তদন্ত করতে আসেন। তিনি কি পুলিশ অফিসার না সাংবাদিক ছিলেন সেই বিশেষ স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি যতক্ষণ নাটক দেখা হয়েছে। সেই ভয়ের কারণে তিনি আধমরা। ভাইয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে চিৎকার করে ডায়লগ বলছেন তাতে অনেকটা দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছিল। তিনি যখন ডাকবাংলায় প্রবেশ করলেন উনার সাথে প্রবেশ করে একজন ভ্যানচালক অর্থাৎ অভিনেতা অনিমেষ মজুমদার। হয়তো তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে ওনার গলার স্বর অনেক চাপা ছিল চেষ্টা করছেন প্রত্যেকটি দশকের কানে যাতে উনার ডায়লগগুলি পৌঁছে। বেশ সাবলীল ভাবে অভিনয় করেছেন ভ্যান চালক অনিমেষ মজুমদার। তারপর থেকে আগত নাটকের কুশীলব একজন সাংবাদিক হিসেবেই যদি ধরি উনি এবং ভ্যানচালক অনিমেষ মজুমদারের বেশ কিছু ডায়লগ গুলি চিৎকার চেঁচামিচির কারণে শ্রুতি মধুর হয়নি। উভয় অভিনেতাই অভিনয়টিকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে উচ্চস্বরে অর্থাৎ ভয়ের কারণে যা ঘটে থাকে তা করতে গিয়ে মনে হচ্ছে বেশি চিৎকার চেঁচামেচি করে ডায়লগ বলছিলেন। পাশাপাশি লাইট ধরে ডায়লগ বলতে উভয়েই অক্ষম মনে হয়েছে। নাটকের দৃশ্য যখন দেখানো হয়েছে ডাকবাংলার একটি ঘর সেই জায়গায় মৃদু আলোর একটি ফ্লাড লাইট জ্বালিয়ে দেখালে ভালো হতো । কিন্তু পরিচালক তা না করে দুটি জোনের সাহায্যে আলো আঁধারি দৃশ্যটি তৈরি করতে চেয়েছেন যা একদম মানায়নি। কারণ জোন বা স্পট লাইট ধরে ডায়লগ বলাটা খুবই অনুশীলনের ব্যাপার যে জিনিসটা সবার মধ্যে খামতি রয়েছে বলে মনে হয়েছে। তবে নাটকের কিছু দৃশ্যে ভ্যানচালক অনিমেষ মজুমদার এবং শহর থেকে আগত সাংবাদিক অর্থাৎ নাটকের পরিচালক শিবব্রত রায়ের ভয় পেয়ে পড়ে যাওয়ার দৃশ্য গুলিকে দর্শক খুব উপভোগ করেছে। তবে এই দিন নাটক দেখতে এসে একটা অভিজ্ঞতা হল যে অনেকদিন পর খোয়াই এর নাট্য প্রেমী দর্শকরা ওই নাটকটি দেখে হাসতে পেরেছে। যা শুভম নাট্য চক্রের কাছে একটি অতিরিক্ত পাওনা । কারণ নাটকের দর্শকদেরকে হাসানো বা আনন্দ দেওয়া সেটা সাধারণ বিষয় নয়। তবে নাটকটিতে অনেক কিছুর খামতি থাকলেও দর্শকদের মন জয় করতে পেরেছে ওটাই যথেষ্ট শুভম নাট্য চক্রের কাছে ।তবে এই বিষয়ে আরো অনুশীলন করার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে নাটক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে। এখানে উল্লেখ থাকে এই নাটকটি রাজ্য স্তরের প্রতিযোগিতা মূলক নাট্য উৎসবে আমন্ত্রিত নাটক হিসেবে ডাক পেয়েছে। সংস্কৃতির দিক দিয়ে খোয়াই শহরকে সাংস্কৃতির শহর হিসেবে গণ্য করা হয় রাজ্য এবং রাজ্যের বাইরে। এর পিছনে মূল কারণ হলো একটা সময় ছিল বিভিন্ন রকমের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করা হতো খোয়াইতে। যার কারনে খোয়াইতে বড় বড় মাপের নাট্যকার তৈরি হয়েছিল। শুভম নাট্য চক্রের এই প্রচেষ্টা হয়তোবা খোয়াইতে আবারো নাটকের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারবে আগামী দর্শকদের কাছে সেই আশায় বুক বেঁধে আছে খোয়াই বাসি।